কুলখানি ও ভুলখানি।

 ভেবে দেখলাম,-- প্রচলিত কুল পাতার পানি দিয়ে মৃতকে গোসল করানো তারপর হয়তো কুল গাছের নিচে সবাই মিলে খানা খাওয়া থেকে কুলখানি শব্দের উৎপত্তি হতে পারে।

যেহেতু কুলখানি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের একটি মুসলিম প্রথা তাই এই নামের উৎপত্তি এরকম কিছু থেকে উদ্ভুত হবার সম্ভাবনা বেশি।

ইসলাম ধর্মে কুলখানি পালনের কথা কোরান, হাদিস, আরবি সামাজিক রেওয়াজ কোথাও নেই, তাই এটি আরবি শব্দ নয়, আরব দেশে কোনো কুলখানি বা মরার পরে খাওয়া দাওয়ার কোন প্রথা কোথাও চালু নেই।

আরব দেশ গুলিতে কেউ মারা গিয়েছে শুনলে সবাই বলে "আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ইউরহাম হু", আল্লাহ তাকে রহম করুন, আল্লাহর প্রশংসা এজন্যে যে আল্লাহর এই সিদ্ধান্তের ওপর আমরা রাজি আর খুশি আছি, আল্লাহ তাঁর দেয়া জান ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন এজন্যে আমাদের খারাপ লাগলেও কান্নাকাটি করছিনা, আল্লাহর সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের কোনো মতান্তর নেই। শুধু আল্লাহ তাকে রহম করুন, ক্ষমা করুন এই দোয়া করছি।

বাংলাদেশে আমার অভ্যাসমত একবার একজনের মরার খবর শুনে "আলহামদুলিল্লাহ" বলার পর প্রায় মাইর খাবার উপক্রম হয়েছিল। আমি মৃতের শত্রু কিনা তাদের নিদারুন সন্দেহ ছিল অনেকদিন ।


'মৃতকে বেহেস্ত নসীব করুন' - এই কথাও আরবরা কেউ বলেনা, কারণ, আরব মুসলিমরা জানে সেটি অনেক লম্বা পথ, বিচার দিনের পরের ঘটনা।

'ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন' কোনো আরবকে মৃত্যুর সংবাদ শোনার পরে বলতে শুনিনি। কোরানের এই আয়াত-- 'সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে', মৃত্যুর সংবাদ শুনে উচ্চারণ করার যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পায়না, কারণ এটি সব সময় তাদের মনে থাকে।

আমাদের মনে থাকেনা বলে আমরা কারো মরার খবর পেলে ইন্নালিল্লা পড়ে মনে করিয়ে দিই, --তোমাকেও মরতে হবে মিয়া ভাই, যদিও এটি শোনার পর আমরা তা উচ্চারণ করি প্রথাগত ভাবে।

মৃত্যুর পুরো ব্যাপারটি যে সত্যিই আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া, সেটি অনুধাবন করে আমরা এই কথাটি বলিনা। কারণ বাংলাদেশে মৃত্যু কোনো ব্যাপার নয়।

সাংবাদিকরাও লেখেন 'তিনি আর নেই', এটি ঠিক আছে।কিনতু 'চির নিদ্রায় আছেন'--কথাটি ইসলামিক মতে ঠিক নয়, কারন মৃত্যুর পরে আমরা অন্য ভাবে বেঁচে থাকি বারযাখে, সেখানে সম্ভবতঃ চির নিদ্রার কোনো চান্স নেই।


মৃত ব্যক্তির জন্যে আরব মুসলিমদের প্রথার নাম হল 'আজা।' মৃত ব্যক্তির মুরব্বিদের সাথে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা আসবেন, হাত মিলাবেন, চুমুর শব্দ করে গাল মেলাবেন, কুশল বিনিময় হবে, অতি ঘনিষ্ঠ জনেরা কিছুক্ষন বসবেন, কফি আর খেজুর সার্ভ করে অনেক বাসায়, অনেক বাসায় কিছুই করেনা।

সৌদি আরবে যে কজন বিশাল প্রিন্সের আজাতে আমি গিয়েছি, আমরা হাজার লোকের সাথে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আরো বিশাল প্রিন্সদের সাথে মুসাফাহা করে এসেছি, নো কমেন্ট,নো খাওয়া দাওয়া, নো দাওয়াত। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি আমি কেন এসেছি, মৃত ব্যক্তিকে আমি কিভাবে চিনতাম।কিছুনা।

এতকিছু লেখার টার্গেট কুলখানি কোনো ইসলামিক নিয়ম নয় এই কথাটিকে এস্টাব্লিশ করা, কিন্তু তার পরেও আমরা কেন করি?

প্রথমত: প্রথার বাইরে আমরা চললে সমাজে আমাদের বদনাম হবে।

দ্বিতীয়তঃ সনদ ছাড়া একটি হাদিস আমাদের মাঝে চালু আছে, "মরার পরে মিসকিন খাওয়ালে যদি মৃত ব্যক্তির কোন নামাজ কাজা হয়ে থাকে, তাহলে যতজন মিসকিন খেয়েছে তার অর্ধেক পরিমাণ ওয়াক্তের নামাজের ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে।"

যদি এটি সত্যি হাদিস হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের তথাকথিত কুলখানিতে কজন মিসকিন দাওয়াত পায় ?

অথচ হাদিস কর্তৃক প্রমাণিত, মানুষ মারা গেলে তার যতগুলো দরজা পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় খোলা ছিল, তার প্রতিটি দরজাই বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সাদকায়ে জারিয়া, আর নেক সন্তানের নেক আমলের লাভ তিনি পেতে থাকবেন।

আর একটি ব্যাপার চালু আছে সেটি হল,যারা জানাজার সময় হাজির ছিল, তাদের সবাই যেন কুলখানির দাওয়াতে থাকে, কারণ জানাজায় আসার কারণে এই খাওয়াটা নাকি তাদের হক।

অংশ গ্রহণ কারি ব্যক্তি যদি জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ নাও পড়ে থাকেন তবুও তাকে খাওয়াতে হবে।

জানাজার মাঠেই যদি দাওয়াত না দেয়া হয়, তাহলে জানাজা থেকে ফেরার পথেই কুলখানির দাওয়াত না দেয়ার বিষয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে যায়।

চট্টগ্রামের শ্রমিক নেতা প্রাক্তন মেয়র মহিউদ্দিন সাহেবের মৃত্যুতে তার জানাজায় বিপুল সংখ্যক লোক হাজির হয়েছিল, উপরোক্ত বেদআত ধারণার কারণে তাঁর কুলখানিতেও হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল।কাকে দোষ দেবো ?

নিরীহ হিন্দু সাধারণ মানুষ কুলখানিতে এসে পদ নিপিষ্ট হয়ে তাদের ভালোবাসার মানুষ মহিউদ্দিন মেয়রের সমগামী হলেন তারা। আজ নয়জনের দাহ হয়েছে। ময়না তদন্ত ছাড়াই তাদের কেন দাহ করা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন করেছে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক।

বাংলাদেশে আমাদের শিখানো হয়েছে বিধর্মী মরলে বলতে হবে, 'ফিন্নারে জাহান্নামা খালিদিনা ফীহা' --একটি বদ দোয়া।

অথচ নবী (সা)এর এতিম অবস্থায় তাঁকে পেলে পুষে বড় করা তার পিতৃব্য আবু তালেব মারা যাবার সময় আল্লাহর নবী তার পাশে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করেছিলেন কলেমা পড়ে মুসলমান হতে, তিনি কলেমা শাহাদাত পড়েননি বা আল্লাহ তার হেকমতের দ্বারা তাকে পড়াননি।

হজরত আলীর (রা) পিতা আবু তালেবের মৃত্যুর পর নবী (সা) কোরানের যে আয়াতটি পড়েছিলেন তার অর্থ হচ্ছে, "কাউকে প্রিয় মনে করলেই তুমি তাকে সৎ পথে আনতে পারবেনা; তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন, আর তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে। (২৮:৫৬)

আর একবার বিধর্মীদের একটি শব যাত্রা সামনে দিয়ে যাবার সময় আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা) বিন আবদুল্লাহ দাঁড়িয়ে গেলে, কেউ বললো, 'রাসুলুল্লাহ, আপনি দাঁড়িয়ে সন্মান দেখালেন, মৃত ব্যক্তি একজন ইহুদি'। নবী (সা) বলেছিলেন, "তিনি কি একটি আত্মা ছিলেন না" ?

বাংলাদেশে মৃত্যু এবং মৃত্যু জনিত সংস্কৃতি পুরোপুরি প্রথামূলক হয়ে গেছে।যারা নবী (সা) এর সত্যিকার অনুসারী তারা নবীর (সা) মত যে কোন মৃতকে তার প্রাপ্য সন্মান দিতে চেষ্টা করি, তা তিনি মুসলমান, হিন্দু,খ্রিস্টান যেই হোক না কেন।

চট্টগ্রামের স্টামপেডে নিহত এই দশজন হিন্দুর মৃত্যু বাংলাদেশের সব মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেলো, ---ইসলামের নামে আবিষ্কৃত (বেদআত) এই কুলখানির আয়োজন না হলে আমরা হয়তো বেঁচে থাকতাম।

দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সব মৃতদেরকে, সব আত্মাকে, আমাদের জানের চেয়ে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর মতো, তার সুন্নতে।
কুলখানি ও ভুলখানি। কুলখানি ও ভুলখানি। Reviewed by poland Trending now Trends on 12:51 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.