আমাদের একেকজনের মধ্যে একেকটা গুণ। সবচেয়ে বড় গুণ অন্যকে সম্মান করা।

নিজে খারাপ ছাত্র হলেও সারাজীবন ভালো ছাত্রদের বন্ধু হবার সুযোগ হয়েছে। স্কুলে থাকতে ক্লাসে স্যার যখন অংক বোঝাতেন, ভালো ছাত্র বন্ধুরা চোখের নিমিষে সেগুলা সমাধান করে হাত তুলে বসে থাকত। আমি কলম টলম কামড়ে আরেকটু পরে কোনমতে শেষ করতাম। কিছু বন্ধু কোনভাবেই শেষ করতে পারত না। তাদের কষ্ট হতো। মাঝে মাঝে তাদের নিয়ে অনেক হাসাহাসি হতো। ছোটকালে আমরা এই ব্যাপারগুলা হয়ত তেমন বুঝতাম না, ইগনোর করা যেত।


কলেজে উঠলাম। দেশসেরা ছাত্রদের সাথে পড়ি। স্কুলেও কিছু বুঝতাম না, কলেজেও কিছু বুঝি না। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র। আত্মীয়-স্বজন জানে ভাই পো, ভাগিনা, ভাতিজা সেরা কলেজে পড়ে। জিনিয়াস। আসল অবস্থা তো আমি জানি। কেমিস্ট্রির মৌল ও যৌগের নাম মুখস্ত করতে হয়। পারি না। বহু কষ্টে ১০টা, ১০টা করে মুখস্ত করে এ সি দাস স্যারের ক্লাস পাশ করলাম। টেস্টে চতুর্থ বিষয় নিয়েছি জীববিজ্ঞান আর মূল বিষয় গণিত। গণিত কিছুই পারি না। টেস্টে ৭৫ না পাইলে বোর্ড পরীক্ষা দিতে দিবে না। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে কোনমতে পাশ করলাম। কিছু বন্ধু পারল না। ছিটকে গেল। খুব ভালো ছাত্র বন্ধুরা ওদের নিয়ে হাসাহাসি করে। এত ভালো কলেজে ভর্তি হইছে, অথচ গণিতে ৭৫ পায় না, বেকুব নাকি! আমি বুঝি, ওরা বেকুব না। এটাও বুঝি, সবাই সমান না।


কর্মজীবনে যারা ফাস্ট রানার তারা অধস্তন কর্মকর্তাদের পারফরমেন্সে মহা বিরক্ত। একটা কাজ করতে ৭ দিন লাগে। ফোন করে সিলেট অফিসে ঝাড়ি। কী কাজ করেন? ২ ঘন্টার রিপোর্ট ৭ দিন লাগায় দেন, কাজ করার দরকার নাই, ইস্তফা দেন। ফোন রাখার পর আমি ডেকে এনে বসাই। আস্তে করে বলি, ভাই আপনি জাহাঙ্গীরনগর থেকে গণযোগাযোগে পাস করছেন আর ওই বেচারা সিলেটের একটা কলেজ থেকে বি এ পাস করছে। আপনার আর ওর পারফরমেন্স এক হইলে আজকে আপনি এখানে ম্যনেজার থাকতেন না, ওই থাকত। বেচারাকে ছোট কইরেন না। আল্লাহ সবাইকে এক করে বানান নাই।

কলেজে এক বন্ধু ছিল। কথা বলত খুব ধীরে। আমি বরাবরই ফট ফট করে কথা বলি। মঞ্চে আমার কোন জড়তা নাই। ওই বন্ধুর সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে একদিন ওর উত্তর দিতে দেরী দেখে আমি ভীষণ খেপে বললাম, 'তো-তো করিস কেন, ব্যাটা ছাগল'। পরে আরেক বন্ধু ডেকে নিয়ে গেল। বলল, ও তো তোতলা। আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। নিজেকে ছোট মনে হলো অনেক।


এখন বিদেশের মাটিতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি ও পড়াই। প্রতি সেমিস্টারে ক্লাস শুরু হবার আগে আমার কাছে চিঠি আসে, তোমার ক্লাসে ২ জন ছাত্রের প্রতিবন্ধিতা আছে। কারও শারীরিক, কারও মানসিক। এমনিতে বোঝা যায় না। তাদের সবধরণের সহযোগিতা করতে হয়, কিন্তু ক্লাসের অন্য কেউ জানতে পারবে না। ক্লাসের পরে ওই ছাত্রদের সাথে আলাদা কথা বলি। তাদের এসাইনমেন্ট জমা দেবার জন্য আলাদা সময় লাগবে কিনা, আলাদা করে বোঝাতে হবে কিনা। হাতে লিখে পরীক্ষা দেবে না কম্পিউটারে দিবে, সব জেনে নেই। এটা আমার চাকরির মধ্যে পড়ে। তাদের সম্মান ও 'dignity' রক্ষা করা top priority.


মানুষকে আল্লাহ অদ্ভুত সুন্দর বৈচিত্র্য দিয়ে বানিয়েছেন। কেউ লম্বা, কেউ খাটো। কেউ ফরসা, কেউ কালো। কেউ ভীষণ মেধাবী, কেউ অল্প মেধাবী। কেউ মাছ ধরতে পারে, আবার কেউ সাতারই জানে না। কেউ কবিতা আবৃত্তি করে, আর কারও উচ্চারণে আঞ্চলিকতার টান। এই যে একেকজনের একেক ধরণ এইটা মেনে নিয়ে, এটাকে সম্মান করে একসাথে থাকাই বন্ধুত্ব বলে আমি মানি। আমাদের প্রত্যেকের চাইতে কেউ না কেউ ভালো লেখে, ভালো গায়, ভালো চাকরি করে, ভালো সংগঠক। কেউ নিজেকে শীর্ষে দাবি করতে পারবে না।


কালকেই বলছিলাম গ্রুপের বন্ধু খালেদের কথা। খালেদ যখন প্রথম গান শুরু করল, ২-৩টা লাইকও পড়ত না। এখন তাঁর গুণমুগ্ধ সবাই। নুরুল লেখার ১ বছর পর পর্যন্ত আমরা জানতাম না বাদশার মতো লেখক এসে মঞ্চ কাঁপিয়ে দেবে। দিদার আব্বাসি যখন গ্রুপে টুকটাক লেখা শুরু করে তখন কেউই তাকে চিনত না। আজকে দিদার সবার প্রিয় পাত্র, সামাজিক একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।


আমাদের একেকজনের মধ্যে একেকটা গুণ। সবচেয়ে বড় গুণ অন্যকে সম্মান করা। আমি একটা সময় প্রতিবন্ধীতা নিয়ে অনেকদিন কাজ করেছিলাম। প্রতিবন্ধী বিষয়ক জাতীয় নীতিমালায় সামান্য অবদান রাখারও সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন অনেক ঘটনা শুনে শিউরে উঠেছি। খুব সাধারণ মানুষ, বড় ব্যবসায়ী কিংবা চাকরিজীবী পাজেরো হাকিয়ে যাবার সময় দূর্ঘটনায় পড়ে আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। এখন হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। আমাদের বন্ধু রিয়াজ একবছর আগেও কি ভেবেছে যে তার লিভার নষ্ট হয়ে যাবে? ভাবেনি। একবছর পর আমাদের কার কি হবে আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন।


বয়স চল্লিশের দিকে যাচ্ছে। অনিশ্চয়তায় থাকি, কখন কি হয়ে যায়। একটাই আশা। হাজার হাজার বন্ধু আছে। উপকার করতে না পারি, কারও অপকার করি না। কাউকে জেনে-বুঝে অপমান করি না, ছোট করি না। অনেক কিছু পছন্দ না হলে এড়িয়ে যাই। মানুষের যে বৈচিত্র্য সেটাকে সম্মান করি। বৈচিত্র্য প্রকৃতির নিজের ধারা। বছরের একেক সময় একেক তাপমাত্রা, এই রোদ এই বৃষ্টি। তেমনই একেক জন মানুষ একেকরকম। মাঝে মাঝে কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করলে ছোটকালের সেই গল্পটার কথা মনে পড়ে যায়। বাচ্চাদের প্রিয় খেলা কুয়ার মধ্যে ব্যাঙদের ঢিল মারা। একদিন এক প্রবীণ ব্যাঙ মাথা তুলে বলল, "যেটা তোমাদের কাছে খেলা, সেটা আমাদের জীবন মরণ সমস্যা।"


আমরা ১৪ হাজার বন্ধুত্বের দাবী তুলে আবার না জেনে, না বুঝে কাউকে ছোট করছি না তো? অবজ্ঞা করছি না তো? আমাদের কাছে যা খেলা, অন্য কারও কাছে তা তেমন নাও হতে পারে। নিজেকেই নিজে বোঝাই আজ আমি যা করছি, আগামীকাল সেটা যেন আমার বা আমার পরিবারের কাছে অন্য কোন রূপে ফেরত না আসে। আজকে যাকে ছোট করছি, হয়ত আগামী বছর সে আমার জীবন বাঁচাবে। এমনটা হবে না, সেটা কেউই বুকে হাত রেখে বলতে পারবে না। ছুটির দিনগুলো ভালো যাক সবার। ভালোবাসা।


#ShamimAJitu2017 #mutual_respect_and_understanding


খ) অন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠি, ধর্ম কিংবা ধর্মহীনতাকে আঘাত করে পোস্ট দেয়া যাবে না। কোন পোস্টে অশ্লীল কিংবা ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।
আমাদের একেকজনের মধ্যে একেকটা গুণ। সবচেয়ে বড় গুণ অন্যকে সম্মান করা। আমাদের একেকজনের মধ্যে একেকটা গুণ। সবচেয়ে বড় গুণ অন্যকে সম্মান করা। Reviewed by poland Trending now Trends on 3:39 AM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.