বিয়ের ট্রেন ফেল করা এক আরব্য বোনের গল্প!!

বাবার গৃহে আমি ছিলাম খুবই আদুরে মেয়ে। পাঁচ ভাইয়ের একটি মাত্র বোন বলে আমার স্নেহ-ভালোবাসা ও আদর-যত্নে কোন ত্রুটি ছিল না। সবাই আমার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতো।আমার সকল আবদার বিনা বাক্যে পরিবারের সকলে মেনে নিতো। আমার চেতনার পুরোটাই জুড়ে ছিল পড়ালেখা। লেখাপড়া ছাড়া অন্যকোন দিকে মনোযোগ দিতে আমি মোটেও রাজি হতাম না। পড়ালেখায় আমার সাফল্যও ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। তাই সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি আমাকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখতো এবং সবাই আমাকে একটু কাছে পেতে চাইতো। আমার সময়গুলো বরাবরের মতো বেশ ভালোই কাটছিল। সময়ের পরিক্রমায় আমি মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ হলাম। একদিন মায়ের দেওয়া একটি সংবাদে প্রথম বারের মতো কাঁপুনি ধরল আমার হৃদয়ে। তিনি জানালেন, অমুক তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তখন আমি কিছুটা আশ্চর্য ও অহংকার মাখা স্বরে বললাম, পরিবারের লোকেরা কি আমাকে নিয়ে তামাশা করছে? এই যে প্রস্তাব আসা শুরু হলো! এরপর থেকে এত ঘন ঘন প্রস্তাব আসতে লাগল যে, আমার অন্য বান্ধবীদের সবার মিলেও বোধ হয় এত প্রস্তাব আসতো না। একবার তো এক বান্ধবীকে গোপনে বলেই ফেললাম, মনে হচ্ছে-আমাদের শহরের সব যুবকই আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে, কেউ আর বাকি থাকবে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করা পর্ন্ত প্রস্তাব আসার এই ধারা অব্যাহত থাকল। তবে এক্ষেত্রে প্রস্তাবের ধরণে কিছুটা পরিবর্ন এলো। আমি সর্বদা একই প্রশ্ন করতাম, ছেলের যোগ্যতা কী? তার মধ্যে কী কী গুণ আছে? আমি আজ তোমাদের কাছে কিছুই লুকাবো না।বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্টের অধিকারী তরুণেরা, বিচিত্র সব পেশার যুবকেরা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা আমার পরিবারের কাছে সম্বন্ধ পাঠাতো। বরং আমি তো এই পর্যন্ত বলবো যে, একবার আব্দুল্লাহ নামের অসাধারণ এক যুবক আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, যে জ্ঞানে-গুণে এতটা সমৃদ্ধ ছিল যে, আর দশজন পুরুষ মিলেও তার কাছে ঘেঁষতে পারবে না।তবুও আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। কারণ, আমি সুন্দরী, আমি মেধাবী-আমার একটা অবস্থান আছে। পড়ালেখার পাট চুকিয়ে যখন কর্মজীবনে পা রাখলাম, সম্বন্ধ আসার ধারা আরও বেড়ে গেল। তবে এতে কিছুটা পরিবর্তন আসলো। যারা প্রস্তাব নিয়ে আসছে তাদের বয়স খানিকটা বেশী- তিরিশের আশেপাশে! যদিও আমার অন্তরে বিপদ ঘণ্টা বেজেই চলছিল, কিন্তু আজকের আগে কখনোই তা শুনতে পাইনি। সময় তার গতিতে বয়ে চলছে। এরই মধ্যে এমন একটি প্রস্তাব এলো, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিলো। জানো সেটা কী? এমন একলোক প্রস্তাব নিয়ে আসলো, যে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে এবং তার একটি সন্তান আছে। এরুপ প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে বড় একটি ধাক্কা খেলাম। পরক্ষণেই বললাম, বেচারা! আমার অবস্থা জানে না, আমি কে? তার জন্য আমার এক ধরণের করুণা হলো। দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়, মাস ফুরোয়, এদিকে আমার বয়সও বাড়তে থাকে। কিন্তু সেদিকে আমার কোন খেয়াল নেই। আমি আমার কাজে নিমগ্ন। বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে একদিকে আমার দৈহিক লাবণ্য ও কমনীয়তা কমতে থাকে; অপরদিকে ক্রমশ বড় হতে থাকে আমার কাজের চাপ ও দায়িত্বের পরিধি, চিন্তা-ভাবনায়ও আসতে থাকে বড় ধরণের পরিবর্তন। আমি সকলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে থাকি এবং আব্দুল্লাহর মতো এক তরুণের প্রস্তাব পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহরণ গুণতে থাকি। কিন্তু আমার আশায় গুড়ে বালি! প্রবাদ আছে, পাখি উড়ে গেছে তার খাবার নিয়ে। আব্দুল্লাহ এখন চার সন্তানের বাবা আর আমি বেচারি এখনো কুমারি বুড়ি! আমার বয়স এখন তিরিশের ছুঁইছুঁই। আশঙ্কাগুলো ঘনীভূত হয়ে আসছে ক্রমশ- ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে জীবন! এই তো আমার বান্ধবী ফাতিমা, সে এখন চার সন্তানের মা। অপর বান্ধবীর কোলজুড়ে চাঁদের মতো ফুটফুটে দু’টি মেয়ে। আরেক বান্ধবী স্বামীকে নিয়ে কী যে সুখে দিন কাটাচ্ছে! অথচ, তাদের আর্থক অবস্থা একেবারেই সাধারণ। আর আমি.......! আমি আরামে দিনাতিপাত করছি। আসলে আমি আত্মপ্রবঞ্চনায় ভোগছি; নিজের সাথে মিথ্যে বলছি। সত্যিই কি আমি সুখে আছি? বিশাল জনতার ভিড়ে এক অদ্ভূত নির্জনতা আমায় ঝেঁকে বসেছে। আমার বয়সের সকল মেয়েই তো একাধিক সন্তানের মা- তারা আদরের সন্তানদের সাথে হাসাহাসি করছে, মধুর স্বরে তাদের সম্বোধন করছে। এদিকে আমার চারপাশে বিচিত্র সব ফিতনা ও পরীক্ষা ভিড় করছে, আমাকে গ্রাস করে ফেলার উপক্রম করছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজ থেকে হিফাজত করেছেন। হয়তো এটি আমার মা-বাবার দুআ ও সুনজরের বরকতে হয়েছে। একদিন আমি অফিস থেকে ফিরলাম। এরই মধ্যে আমার তীক্ষ্ণ বেধা ও কঠিন অধ্যবসায় কর্মক্ষেত্রে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের সর্বাচ্চ স্তরে। কিন্তু এই সফলতা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। আমি কাজ থেকে বাসায় ফেরি দেখি, মা আমার উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে আমার বালিশের ওপর রেখে দিয়েছেন। তাতে লেখা, মেয়ে আমার! অমুক তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে ভালো চাকুরি করে, আর তার বয়সও কম। আশা করি, তুমি সায় দিবে-যদিও তার অন্য এক স্ত্রী ও ছয়জন সন্তান রয়েছে। দিন কিন্তু চলে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে আমাকে জানাও। আমি চিরকুটটি গভীর মনোযোগে পড়লাম এবং রাগে ফেটে পড়লাম। আমি মাথার চুলের দিকে তাকালাম। মাঝে মাঝে সাদা হয়ে ওঠা চুলগুলো লুকাতে এরই মধ্যে আমি কলপ লাগাতে শুরু করেছি। ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত এমন একজন লোকও আমাকে প্রস্তাব দিলো? আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। রেগেমেগে সেই সন্ধ্যায় আমি বাবার কাছে গেলাম। তাঁকে বললাম, কিভাবে আপনারা এমন একজন মানুষের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন যার ছয় সন্তান আছে? আমার পিতার উত্তরটি আমার অন্তরে ধারালো ছু্রির মতো বিদ্ধ হলো। তিনি বললেন, গত কয়েক মাসে আমাদের কাছে এমন বিবাহিতরা ছাড়া অন্য কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসেনি। আমার ভয় হয়-কিছুদিন পর হয়তো এমন সময় আসবে, যখন প্রস্তাব আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়ে আমার! মুরব্বিরা একটা কথা বলতেন, মেয়েরা গোলাপের মতো-ছিঁড়তে দেরি করলে এর পাপড়িগুলো ক্রমশ শুকিয়ে আসে। আমার মনে হয়, তুমিও এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মেয়ে, তোমার কাছে তো শত শত প্রস্তাব এসেছিল, তুমি একটা একটা করে সবগুলোই প্রত্যাখ্যান করেছো। ও বেশি লম্বা, সে বেশি খাটো, ওর এই দোষ, অমুকের এই সমস্যা! আর এখন.....? এমন সময় এসেছে, তুমি কাউকেই পাচ্ছ না......! পরের দিন মাগরিবের পর আমি মা-বাবার সাথে কিছুক্ষণ বসলাম। লক্ষ্য করলাম, তারা আমার দিকে স্নেহ-ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি একজন বয়স্ক কুমারী মেয়ে-যে বিয়ের ট্রেন ফেল করেছে। অথচ, ট্রেন তার চোখের সামনে তার সমবয়স্ক বান্ধবীদের নিয়ে চলে গেছে। ভাবতে ভাবতে আমি কেঁদে ফেললাম। আব্বুকে বললাম, ইস! আপনি যদি বিষয়টি সামাল দিতেন! তিনি বললেন, কিভাবে? আমি বললাম, আপনি যদি আমার হাত ধরে আপনার পছন্দের পাত্রের হাতে আমাকে তুলে দিতেন! আপনি কি আব্দুল্লাহ কে পছন্দ করতেন না? আপনি কি তার প্রশংসা করতেন না? আব্বু, আপনি যদি তখন এমনটি করতেন, তবে আমি এখন আপনাকে তিরস্কার করতাম না। হায়, আপনি যদি এর জন্য আমাকে প্রহার করতেন!! বলতে বলতে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। জীবনের এই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরলাম আমার মতো বোনদের কল্যাণের প্রত্যাশায়। আমি চাই না, আমার মতো করুণ পরিণতি কোন বোনের হোক...!
বিয়ের ট্রেন ফেল করা এক আরব্য বোনের গল্প!! বিয়ের ট্রেন ফেল করা এক আরব্য বোনের গল্প!! Reviewed by poland Trending now Trends on 1:44 AM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.